ঘুরে দেখুন পুন্ড্রনগরী মহাস্থানগড়
মমিনুল ইসলাম মোল্লাউইকিপিডিয়ায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের সর্ব প্রাচীণ ও সর্ববৃহৎ নগর পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে মহাস্থানগড়ে। পুন্ড্র রাজ্যের রাজধানী ছিল এটি। তবে কখনও কখনও প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রমত্তা করতোয়ার তীরে গড়ে উঠেছিল এ নগর। এখন সেই সেই করতোয়া নেই ,নেই কোন বন্দর, ভীড়েনা কোন জাহাজ, রাজপথে ছুটে চলে না রাজা -মন্ত্রীর শকট, রাজপথে দেখা যায় না হাতি- ঘোড়ার বহর,পড়তে আসেনা কোন বিদেশী ছাত্র,পসরা সাজায়না কোন বিদেশী বণিক । তবুও মহাস্থানগড়ের গুরুত্ব এতটুকু কমে যায় নি। মনের চোখে সব কিছুই দেখবেন। সবই যেন ঘুমিয়ে রয়েছে মহাস্থানগড়ের মাটির তলায়। একে একে সবকিছু ঘুওে দেখুন।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে গেলে গ্রীণ লাইন, টি আর ট্রাভেলস, কিংবা এস আর পরিবহনে যেতে পারেন। এছাড়া শ্যামলী, হানিফ, কেয়া, বিআরটিসি, শাহ সুলতানের মাধ্যমেও যেতে পারেন। ঢাকার গাবতলী থেকে বাসে উঠতে পারেন। বগুড়া শহরে নেমে টেম্পোতে চড়ে যাবেন মহাস্থানগড়ে।
মহাস্থানগড় দুর্গ নগরীটি পর্যায়ক্রমে মাটি ও ইটের বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত। এটি উত্তর-দক্ষিণে ১৫২৫ মিটার দীর্ঘ, এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৭০ মিটার প্রশস্থ ও চতুপার্শ্বস্থ সমতল ভূমি হতে ৫ মিটার উঁচু। ৩৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং ১০/১৫ ফুট প্রশস্থ ছিল এর নিরাপত্তা দেয়াল। প্রাচীরের উপর দিয়ে কয়েকজন সৈন্য পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারতো। এ যেন চীনের মহাপ্রাচীর। সুরক্ষিত এই নগরীরর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার সময় শুনবেন- ১৯২৮-২৯ সালে পুন্ড্রনগরের প্রতœতাত্তিক খনন শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে মুনীর ঘোন, বৈরাগী ভিটা ও গোবিন্দ ভিটা আবষ্কিৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে খননের ব্যাপারে ফ্রান্স সরকারের সাথে চুক্তি হয়। সুরক্ষিত দেয়াল বাদেও উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে একটি গভীর পরীখা ছিল।
খননঃ ১৯২৮-২৯ সালে কে এন দীক্ষিতের তত্বাবধানে ভারতের প্রতœতাত্মিক জরিপ বিভগ প্রথম খনন কাজ শুরু করে। ১৯৩১ সালে এখানে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়্ এতে স¤্রাট অশোকের বাণী লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রথম দিকে বৈরাগীর ভিটা , গোবিন্দ ভেটা, ও মুনির ঘুন নামক স্থানে খনন করা হয়। ষাটের দশকে খনন কাজ চালিয়ে পরশু রামের প্রাসাদ, খোদার পাথরভিটা, ও মানকালীর কুন্ডে ধাপে ধাপে খনন কার্য চালানো হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আবার খননকাজ চালানো হয়। ১৯৯২ সালে ফ্রান্সের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন কওে খনন ও অনুসন্ধান কাজ চালানো হয়। সেখানকার কোন দোকানে বসে চা খেতে খেতে হয়তো শুনবেন ১৮৭৯ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতœত্তবিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম এ ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এছাড়া বুকানন হ্যামিল্টন, ডোনেল, ওয়েস্টম্যাক্ট ও বেভারিজের অবদানও ছিল অবিস্মরনীয়।
প্রাপ্ত বস্তুঃ এ পর্যন্ত খনন করে মৌর্য যুগের টাপিযুক্ত শিলাখন্ড তা¤্রমূদ্রা, পোড়ামাটির মূর্তি, ধাতব দ্রব্যাদি, আরবি উৎকীর্ণ লিপিযুক্ত একটি প্রস্তর ফলক পাওয়া গেছে। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত দুটি বিষ্ণু মূর্তির একটি বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এবং অপরটি ভিক্টোরিয়া এান্ড এ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।এখানকার বিভিন্ন বস্তু দেখার সময় আপনার জানতে ইচ্ছা হবে এই গৌরবময় নগরী কে বা করা সৃষ্টি করেছিল? কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন- খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে ৫মশতাব্দীর র মধ্যে পুন্ড্রনগরে একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠে। খৃষ্টপূর্ব চার শতকের “কৗটিল্যের অর্থ শাস্ত্রে ”ও দুই শতকের “ বৈয়াকরণ” কিংবা পানিনির রচনাতেও পুন্ড্রনগরের ইতিহাস পাওয়া যায়। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষ ভ্রমণকালে (৬৩৯-৬৪৫) পুন্ড্রনগর পরিদর্শন করেন। তার বর্ণনামতে-মহামতি গৌতুম বুদ্ধ নিজে পুন্ড্রবর্ধনে এসে ৩ মাস অবস্থান করেছিলেন।
দর্শনীয় স্থান সমূহঃ
জিয়ৎকুন্ডঃ দুর্গনগরীর মূল দেয়ালের ভেতরেই দেখবেন জিয়ৎকুন্ড। এটি একটি বড় কুপ। এ কুপের পানি পান করে রাজা পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হতো।
মসজিদঃ গড়ের দক্ষিণ পূর্ব কোন ঘেষে সামনে এগুলেই একটি মসজিদ চোখে পড়বে। এটি স¤্রাট ফররুখ শিয়ারের আমলে প্রথম তৈরি হয়। খোদা দীল নামক এক ব্যাক্তি এটি তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে মসজিদের পূর্বের আকৃতি এখন আর দেখবেন না। একে পরবর্তীতে সংস্কার সাধন করা হয়েছে।
মাজার ঃমসজিদের কাছেই দেখতে পাবেন একটি মাজার। এটি আফগানিস্থান থেকে আগত পীর হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ মাহী সওয়ারবলখী (রঃ) এর। আনুমানিক ১২০৫ -১২২০ সালের মধ্যে অত্যাচারী রাজা পরশুরামের সঙ্গে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধে পরশুরাম নিহত ও পরাজিত হন।
খোদার পাথরভিটাঃ মাজার থেকে ৬০০ ফুট উত্তরেখোদার পাথরভিটা দেখতে পাবেন। এটি লম্বায় ৯ফুট ৪ ইুঞ্চি চওড়ায় আড়াই ফুটএবং এর উচ্চতা ২ ফুট ৫ ইঞ্চি। একে অনেকে পুজা করে থাকে। এটি একটি গ্রানাইট পাথর। একে খোদার পাথর বলে স্থানীয়রা অভিহিত করলেও দুএকজনের কাছে আসল ঘটনা জানবেন। প্রকৃতপক্ষে খুব সম্ভব খ্রিষ্টীয় ৬ শতকে এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল আর এটি ছিল সে মন্দিরের দেয়ালের একটি অংশ।
মানকালীর কুন্ডঃ ৬০০ ফুট উত্তরে দেখবেন মানকালীর কুন্ড। স¤্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ও তার ভাই তানসিংহ নাকি এখানে একটি মন্দির তৈরি করেছিলেন। এখানে একটি অতি গভীর কুন্ড কবা কুপ ছিল। তবে মুসলমানদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলবেন আপনি যা শুনেছেন সবই বানানো গল্প। আসলে এখানে একটি মসজিদ ছিল। এটি খুব সম্ভবচৌদ্দ কি পনের শতকে তৈরি হয়েছিল তবে মন্দিরই বলুন আর মসজিদই বলুন কোনটিরই পূর্ন অবয়ব দেখতে পাবেন না।
পরশুরামের বাড়িঃ মানকালীর কুন্ড থেকে প্রায় ২০০ গজ উত্তরে রাজা পরশুরামের বাড়ি দেখতে পাবেন। আগেই জেনেছেন রাজা পরশুরাম পীরের সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এ ঢিবিটির আয়তন ২০০*১০০ ফুট। প্রায় ২০০ বছর আগে তৈরি এ দালানে ৪টি আলাদা মহল ছিল। পরশুরাম ছিলেন নিষ্ঠুর। সে কুঠার দ্বারা নিজ মাকে হত্যা করায় কুঠার আটকে যায়। কথিত আছে ,এখানে এসে করতোয়ার জলে হাত ধুয়ে তিনি অভিশাপমুক্ত হন। তখন এ অঞ্চলে রাজা নল ও নীল এর মধ্যে ভ্রাতৃ সংঘর্ষ চলছিল; এ সুযোগে তিনি রাজ্য দখল করে নেন।
বৈরাগীর ভিটাঃ পরশুরামের বাড়ি থেকে প্রায় ৭০০ গগজ উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত স্খথানটি বৈরাগীর ভিটা নামে পরিচিত। এটি পাশের জমি থেকে ১০ ফুট উচু। প্রস্থে এটি ২৬০ ফুট এবং লম্বায় ৩০০ ফুট। এখানে দুটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল বলে জানা যায়।
শীলদেবীর ঘাটঃ বৈরাগীর ভিটার উল্টোদিকে দুর্গপ্রাচীরের ২০০ গজ পূর্বে করতোয়া নদীতে শীলাদেবীর ঘাট দেখতে যাবেন। এ মহিলা ছিল রাজা পরশু রামের বোন। যুদ্ধের সময় আত্মশুদ্ধির জন্য শীলা দেবী এখানে আত্মাহুতি দেন। প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে এখানে হিন্দুরা পুন্য¯œানে মিলিত হন। এ উপলক্ষে এখানে মেলাও বসে।
জাদুঘরঃ মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে ১ কিলোমিটার দূরে আবস্থিত জাদুঘরে যাবেন। এখানে দিনাজপুর ,পাহাড়পুর,শেরপুর ,রাণী ভবানীপুর এলাকা থেকে উদ্ধার করা প্রতœসামগ্রী দেখতে পাবেন। সোনা, রুপা, লোহা, ব্রোঞ্জ, পাথর, কাসা ও পোড়ামাটির তৈরি বিভিন্ন বস্তু দেখে অবাক না হয়ে পারবেন না।
কোথায় থাকবেনঃ বগুড়া শহরে কয়েকটি উন্নতমানের হোটেল রয়েছে। এগুলোর যে কোন একটিতে আগে থেকেই বুকিং নিতে পারেন। তবে হোটেল নাজ গার্ডেন, ( ছিলিমপুর), হোটেল সেফওয়েতে ( চার মাথার মোড়), উঠতে পারেন। এগুলোতে ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকায় অনায়াসে থাকতে পারবেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যপারেও কোন চিন্তা করবেন না। বগুড়ার কোন কোন হোটেলে কভুতরের রোস্ট, হাঁসের গোশত, রকমারি ভর্তা, চাউলের রুটি, কিংবা সুস্বাদু লুচি পাওয়া যায়। সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখা আপনার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। ৮ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নানা কীর্তি। নগরকেন্দ্রের বাইরেও রয়েছে বহু কীর্তি। সবগুলো দেখার সময় হয়তো আপনার হাতে নেই। তাই অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু দেখা যায় তা দেখেই এবার ফেরার কথা ভাবুন। কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে আমরা অনেকেই অনেক কিছু নিয়ে আসি। আপনি যদি দই পছন্দ করেন তাহলে পুরাতন মহরমের দইঘর থেকে দই নিয়ে আসতে পারেন। এছাড়া শেরপুরেও অনেক দইয়ের দোকান পাবেন।
লেখকঃ কলেজ শিক্ষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক ক্যাম্পেনার;
0 Comments